
টি কোষ (T-Cell): এক প্রকারের লসিকাকোষঃ

টি কোষ এক প্রকারের লসিকাকোষ (শ্বেতকণিকা) যেগুলি দেহের অনাক্রম্যতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং যেগুলি দেহে বহিরাগত পদার্থ তথা প্রত্যুৎপাদকসমূহের বিরুদ্ধে উপযোজী অনাক্রম্য প্রতিক্রিয়ায় নির্দিষ্টকরণে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে। টি কোষগুলি লসিকাকোষের দুইটি প্রধান ধরনের একটি ধরন; অপর ধরনটি হল বি কোষ। টি কোষগুলির কোষপৃষ্ঠে টি-কোষ গ্রাহক থাকে, যার দ্বারা এগুলিকে অন্যান্য লসিকাকোষ থেকে পৃথক করে চেনা যায়। টি কোষগুলি অস্থিমজ্জায় অবস্থিত রক্তোৎপাদী কাণ্ডকোষগুলি থেকে উৎপত্তিলাভ করে।
(১) বিকাশমান টি কোষগুলি এরপর বক্ষকোটরে অবস্থিত থাইমাস গ্রন্থিতে অভিবাসিত হয় ও সেখানে আরও বিকাশ লাভ করে (বা পরিপক্বতা লাভ করে)। থাইমাস গ্রন্থিতে বিকাশলাভ করে বলে গ্রন্থিটির ইংরেজি আদ্যক্ষর “টি”-র নামে এই কোষগুলির নামকরণ করা হয়েছে টি লসিকাকোষ বা টি কোষ।
(২) থাইমাস গ্রন্থিতে অভিবাসনের পরে এই পূর্বগ কোষগুলি সংখ্যাবৃদ্ধি করে ও পরিপক্বতা লাভ করে বেশ কিছু স্বতন্ত্র প্রকারের টি কোষে পরিণত হয়। এগুলির মধ্যে রয়েছে কোষ-বিষাক্তকারক বা ঘাতক টি কোষ, সাহায্যকারী টি কোষ, নিয়ন্ত্রক টি কোষ এবং স্মৃতি টি কোষ। এরপর এগুলিকে প্রান্তীয় দেহকলায় প্রেরণ করা হয় কিংবা রক্ত সংবহনতন্ত্রের রক্তে বা লসিকাতন্ত্রের লসিকারসে এগুলি সঞ্চালিত হতে শুরু করে।
√ টি কোষ (টি লসিকাকোষ) cell Healthy Human T Cell.একটি মানব টি কোষের ক্রমবীক্ষক ইলেকট্রন অণুবীক্ষণ চিত্র Red White Blood cells.
লোহিত কণিকা (বামে), অনুচক্রিকা (মধ্যে) ও টি লসিকাকোষের (রঞ্জিত) ক্রমবীক্ষক ইলেকট্রন অণুবীক্ষণ চিত্র। থাইমাস গ্রন্থি পরিত্যাগ করার পরেও টি কোষের স্বতন্ত্রীভবন ঘটতে পারে। বিশেষ স্বতন্ত্রীভূত টি কোষের উপপ্রকারগুলির দলগুলি অনাক্রম্য প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ ও রূপদানে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই ভূমিকাগুলির একটি হল অনাক্রম্য-মধ্যস্থতাকৃত কোষ মৃত্যু; মূলত দুই ধরনের টি কোষ এই কাজটি পালন করে, সিডি৮+ “বিষাক্তকারক” বা “ঘাতক” টি কোষ এবং সিডি৪+ “সাহায্যকারক” টি কোষ (কোষের পৃষ্ঠতলে অবস্থিত সিডি৮ ও সিডি৪ প্রোটিনগুলির উপস্থিতির কারণে এইরূপ নামকরণ করা হয়েছে)।
√ সিডি৪+ “সাহায্যকারক” টি কোষগুলির কাজ হল স্মৃতি বি কোষ ও কোষ-বিষাক্তকারক সিডি৮+ টি কোষগুলিকে সক্রিয় করা, যার ফলে অনাক্রম্য প্রতিক্রিয়ার আকার বৃদ্ধি পায়। যখন সাহায্যকারক টি কোষগুলি একটি যথোপযুক্ত প্রত্যুৎপাদক দ্বারা উদ্দীপ্ত হয়, তখন সেগুলি রাসায়নিক সংকেত বা বার্তাবাহী কিছু প্রোটিন নিঃসৃত করতে শুরু করে, যেগুলিকে সাইটোকাইন বলে। সাইটোকাইনগুলির কারণে স্মৃতি বি কোষগুলি প্রতিরক্ষিকা (অ্যান্টিবডি) উৎপাদনকারী প্লাজমা কোষে স্বতন্ত্রীভূত হতে শুরু করে। সাহায্যকারক টি কোষগুলিকে এগুলি থেকে নিঃসৃত সাংকেতিক প্রোটিন বা সাইটোকাইনের উপর ভিত্তি করে বেশ কিছু স্বতন্ত্র উপপ্রকারে ভাগ করা যায়, যেগুলির একেক রকম নির্দিষ্ট উপযোজী অনাক্রম্য প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। এর বিপরীতে সিডি ৮+ ঘাতক টি কোষগুলি কোষের জন্য বিষাক্ত পদার্থে পূর্ণ; এগুলি বিভিন্ন ধরনের সাইটোকাইন দ্বারা উদ্দীপ্ত হয়ে সরাসরি ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত দেহকোষ ও কর্কটকোষগুলির সাথে আবদ্ধ হয়ে সেগুলিকে মেরে ফেলতে পারে। অধিকন্তু সিডি৮+ টি কোষগুলিও নিজস্ব সাইটোকাইন নিঃসরণ করে অনাক্রম্য প্রতিক্রিয়াতে অন্যান্য ধরনের কোষকে মোতায়েন করতে পারে।
(৩) টি কোষসমূহের আরেকটি বৃহৎ দল হল নিয়ন্ত্রক টি কোষ। এগুলি অনাক্রম্য সহনশীলতা নামক অতি গুরুত্বপূর্ণ কার্যপদ্ধতিটি প্রদান করে। এক্ষেত্রে অনাক্রম্য কোষগুলি পোষকদেহের নিজস্ব নির্দোষ দেহকোষ থেকে বহিরাগত আক্রমণকারী দ্বারা আক্রান্ত দেহকোষগুলি শনাক্ত করতে পারে। এর বদৌলতে অনাক্রম্য কোষগুলি ভুল করে নিজদেহের কোষগুলিকে আক্রমণ করা থেকে বিরত থাকে, যে অবাঞ্ছিত ব্যাপারটিকে স্বতঃঅনাক্রম্য প্রতিক্রিয়া বলে। এই কারণে নিয়ন্ত্রক টি কোষগুলিকে অনেক সময় অবদমক টি কোষ নামেও ডাকা হয়। কিন্তু এই একই নিয়ন্ত্রক টি কোষগুলিকে কর্কটকোষগুলি নিজেদের কাজে লাগাতে পারে, যাতে অর্বুদ বা টিউমার কোষগুলির বিরুদ্ধে দেহের অনাক্রম্য প্রতিক্রিয়া অবদমিত হয়।
√ মানবদেহে লক্ষ লক্ষ টি ও বি কোষ রয়েছে, যেগুলির অনেকগুলির অনন্য গ্রাহক রয়েছে। তাই দেহ প্রায় যেকোনও ধরনের প্রত্যুৎপাদকের বিরুদ্ধে অনাক্রম্য প্রতিক্রিয়া প্রদান করতে পারে।
√ অ্যান্টিবডি সম্পর্কিত
পরিপক্ক বি-কোষ থেকে উৎপন্ন বৃহৎ ইংরেজি ওয়াই-আকৃতির প্রোটিন যা দেহের অনাক্রম্যতন্ত্র ব্যাকটেরিয়া কোষ-বিষাক্তকারক টি কোষ
এক ধরনের টি লসিকাকোষ যেগুলি কর্কটকোষ, জীবাণু-সংক্রমিত কোষ বা অন্যান্য ক্ষতিগ্রস্ত কোষ ধ্বংস করে।
★ টি-সেল প্রতিরোধসমূহঃ-
*************************
বিজ্ঞানীরা এমন এক ধরনের রোগ প্রতিরোধকারী কোষ (টি-সেল) আবিষ্কার করেছেন যা ক্যান্সার আক্রান্ত কোষকে নিশানা করে তার আক্রমণ ক্ষমতা বা কার্যক্ষমতাকে ধ্বংস করতে সক্ষম। বিজ্ঞানীদের দাবি, টি-সেল ক্যান্সার থেরাপির সাহায্যে দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা ছাড়াই একাধিক ধরনের ক্যান্সার কোষকেই ধ্বংস করতে সক্ষম।
√ টি-সেল হল এক ধরণের শ্বেত রক্তকণিকা যা আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা ও তার (ইমিউন সিস্টেম) কার্যকলাপের অন্যতম অঙ্গ। এই টি-সেল শরীরে প্রবেশ করা ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়া বা ছত্রাকের সংক্রমণকে প্রতিহত করে আমাদের সুস্থতা বজায় রাখে।
√ কার্ডিফ ইউনিভার্সিটির একটি গবেষক দল একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন যার ফলে ফুসফুস, ত্বক, লিউকেমিয়া, কোলন, স্তন, প্রোস্টেট, বোন, কিডনি, জরায়ু এবং ওভারিয়ান ক্যান্সারগুলো ধ্বংস করা সম্ভব হবে। নেচার ইমিউনোলজি জার্নালে তাদের এই গবেষণা প্রকাশ হয়েছে। বিজ্ঞানীরা কৃত্তিম উপায়ে এই রোগ প্রতিরোধকারী টি-সেল বা শ্বেত রক্তকণিকার সংখ্যা বাড়িয়ে সেগুলিকে ক্যান্সারের টিউমার বা ক্যান্সার কোষকে (ম্যালিগন্যান্ট টিউমার) ধ্বংসের উদ্দেশ্যে চালিত করছেন। এর ফলে কেমোথেরাপি ছাড়াই ক্যান্সার কোষকে ধ্বংস করা সম্ভব।
√ বিজ্ঞানীরা রক্ত থেকে শ্বেত কণিকা (টি-সেল) সংগ্রহ করে সেগুলিকে পরীক্ষাগারে কৃত্তিম উপায়ে বিভাজিত ও বৃদ্ধি ঘটাচ্ছেন। এর পর ওই কোষগুলির জিনগত পরিবর্তন ঘটিয়ে সেগুলিকে এমন ভাবে চালিত করছেন, যাতে কৃত্তিম ভাবে তৈরি ওই কোষগুলি শুধুমাত্র ক্যান্সার কোষকেই ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে চালিত হয়।
★ বিজ্ঞানীরা নতুন ধরনের এই কোষগুলির নাম দিয়েছেন এমআর-
১। তবে এখনও পর্যন্ত এটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর্যায়েই রয়েছে। এখনও পর্যন্ত পরীক্ষাগারেই ইঁদুর বা মানব কোষের উপর প্রয়োগ করা হয়েছে এই বিশেষ টি-সেল। পরীক্ষা সফলও হয়েছে। সরাসরি মানুষের উপর প্রয়োগের জন্য আরও কয়েক ধাপ পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রয়োজন রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
√ গবেষক অধ্যাপক অ্যানড্রু সিওয়েল বিবিসিকে বলেছেন ‘এটাতে সব রোগিকে চিকিৎসা করার একটা সুযোগ রয়েছে।’ তিনি জানান, আগে কেউ বিশ্বাস করেনি এটা সম্ভব হতে পারে। একটা কোষ দিয়ে সব ক্যান্সারের চিকিৎসার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিয়েছে। যেটাকে ইংরেজিতে বলে ‘ওয়ান ইজ ফিটস্ অল।’
√ টি-সেলের ‘রিসেপ্টর’ আছে। রিসেপ্টর হল একটা সেল বা কোষ যেটা আলো, তাপ বা অন্যান্য উদ্দীপক বস্তুর প্রতিক্রিয়া পাঠাতে পারে। এর ফলে তারা রাসায়নিকের মাত্রাটা দেখতে পারে। কার্ডিফের এই গবেষক দলটি রক্তের এই টি-সেল এবং তার রিসেপ্টর আবিষ্কার করেছে যেটা দিয়ে পরীক্ষাগারে বৃহৎ পরিসরে ক্যান্সারের সেল আবিষ্কার করা এবং ধ্বংস করতে পারে। এই নির্দিষ্ট টি-সেলের রেসেপ্টর এমআরওয়ান নামে একটা অণুর সাথে মিথস্ক্রিয়া করানো হয়েছে যেটা মানুষের শরীরের প্রত্যেক সেলের উপরিভাগে থাকে।
√ টি-সেল থেরাপি আগে থেকেই রয়েছে। তবে ক্যান্সার প্রতিরোধক থেরাপির উন্নয়ন এই ক্ষেত্রে অন্যতম উত্তেজনাকর অগ্রগতি। অতি বিখ্যাত উদাহরণ হল সিএআর-টি। এটা হল একটা জীবিত ওষুধ যেটা রোগির টি-সেল খুঁজে বের করবে এবং ধ্বংস করবে। সিএআর-টি’র একটা নাটকীয় ফলাফল হতে পারে, যার ফলে যে রোগি মৃত্যুর দিকে ধাবিত হতে পারতো তাকে আগেই পুরোপুরি সারিয়ে তুলবে। যাইহোক, এর লক্ষ্য ছিল খুবই নির্দিষ্ট এবং যেটা সীমিত সংখ্যার ক্যান্সারের ক্ষেত্রে কাজে লাগে।
√ অন্যদিকে টি-সেলকে প্রশিক্ষণ দেয়ার একটা পরিষ্কার লক্ষ্য আছে যাতে ক্যান্সার ধরতে পারে। এবং এটা ব্লাড ক্যান্সার বা লিউকেমিয়াতে যতটা সফলতা পেয়েছে টিউমার থেকে যে ক্যান্সার হয় সেটাতে সফলতা আনতে ততটাই হিমশিম খাচ্ছে। গবেষকরা বলছেন তাদের টি-সেল রিসেপ্টর সার্বজনীন ক্যান্সারের চিকিৎসার প্রতিনিধিত্ব করতে পারে।